ভেঙে মোর ঘরের চাবি - দ্বিতীয় পর্ব
- প্রদীপ্ত দে
- Nov 18, 2021
- 14 min read
Updated: Dec 11, 2021
(প্রথম পর্বটি পড়ুন এই লিঙ্কে ক্লিক করে)
দ্বিতীয় পর্ব
ভবানীপুরের নর্দান পার্ক অতিক্রম করে একটা গলিতে ঢুকেই বাঁদিকে প্রথম বাড়ি। তিনতলা বাড়িটার দরজার ডানদিকে মার্বেল ফলকে লেখা আছে নাম " স্মৃতি কুঞ্জ "। বাড়িটার সামনে দাঁড়ালে তিনটে তলার বারান্দা এবং সাথে লাগোয়া ঘরগুলো রাস্তার ওপার থেকে পরিস্কার দেখা যায়। ঋজু বাড়ির উল্টোদিকে তাকাল। একখানা শিব মন্দির এবং তার পাশে একখানা ইস্ত্রি করার গাড়ি আর একটা পানের দোকান। সবই একতলা বা চালাঘর। যার পেছনে একখানা গাড়ি রাখার খোলা গ্যারেজ। অন্তত একটা দোতলা বাড়ি থাকলে ঘটনার অনেক প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যেত।
আমরা কলিং বেল বাজানোর আগে বাড়িটার বাইরেটা অনেকটা দেখলাম। বাড়িটার বাঁপাশে রাস্তা। ডানপাশে আরেকটা বেশ বড় আকারের অ্যাপার্টমেন্ট। বাঁদিকের দেওয়াল বরাবর রাস্তা লাগোয়া তিনধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে একখানা দরজা, যেটা ভেতর থেকে বন্ধ। আমরা প্রধান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফোন করলাম অনামিকা দেবীকে। নীচে নেমে আমাদের দরজা খুলে দিয়ে পলাশবাবু বললেন
- আমার স্ত্রী ওপরে আছে। তিনতলায়। আসুন।
আমরা বাড়িটার ভেতরের খানিকটা আভাস পেয়েই গেছিলাম। ভেতরে ঢুকে শুধু চারপাশে চোখ বুলিয়ে মেলাতে লাগলাম।
বাড়িটার বাইরে থেকে ভেতরে ঢোকবার সত্যিই কোনো উপায় নেই। আমরা আগে তিনতলাতেই গেলাম। অনামিকা দেবী তিনতলার সিঁড়ির মুখেই দাঁড়িয়ে আছেন। উনি আমাদের প্রথমে নিয়ে গেলেন তিনতলার বারান্দা বরাবর ডানদিকের শেষ ঘরে। বেশ বড় আকারের খাবার ঘরের একপাশে আর্চ করা রান্নাঘর। রান্নাঘরে একজন কমবয়সী সুশ্রী মহিলা। বয়স তিরিশের মধ্যে। গায়ের পোশাক-আশাক বলে দিচ্ছে যে মহিলা পরিচারিকা। অনামিকাদেবী আলাপ করালেন। এনার নামই কল্পনা। মনেহয় চা বানাচ্ছে। একটা বড় উপবৃত্তাকার কাঠের টেবিল। যার চারপাশে রাখা আছে কাঠের চেয়ার। আমি আর ঋজু ঘরে ঢুকে বসলাম না। কারণ প্রতিটা চেয়ারের বসার জায়গা টেবিলের ভেতরে ঢোকানো। দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার রাখা আছে। আমাদের বসতে বলা হল সেখানে। ঋজু ইশারায় জানালো যে আমরা দাঁড়িয়েই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। একটা চেয়ারের অবস্থান দেখিয়ে অনামিকা দেবী বললেন
- আমাকে প্রথমে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ছবিতে দেখেছি যে বড়দা এই চেয়ারেই বসে মারা গেছিলেন। আর বাঁদিকে এখানে ছিল পায়েসের সেই কাপটা।
ঋজু জিজ্ঞেস করলো
- কাপসেটটা দেখানো যায়?
- সেটাও ছবিতে দেখতে হবে। কারণ, কাপগুলো সব পুলিশের হেফাজতে।
ছবিটা দেখলাম।একটা স্টিলের ট্রে – এর ওপরে রাখা আছে দুখানা কাপ। সাধারণ স্টিলের সরু মুখের কাপ। অনেকটা শ্যাম্পেনের গ্লাসের আকারের। ছবিটা দেখতে দেখতে ঋজু জিজ্ঞেস করল
- এই ছবিটাতে তো দুটো কাপ রাখা আছে। কটা কাপের সেট ছিল?
- মেজদার ফ্রিজের ভেতরে এইভাবেই রাখা ছিল। মনেহয় আমাদের দুজনের ভাগের পায়েস বুঝলেন। একটু দাঁড়ান।কটা কাপের সেট ছিল, এই ব্যাপারটা মেজবৌদিই বলতে পারবে। আসলে এই কাপসেটটা বড়বৌদি ভাইজাগ বেড়াতে গিয়ে নিয়ে এসেছিল।
অনামিকাদেবী কল্পনা নামের মেয়েটিকে নীচে পাঠালেন মেজবৌদিকে ডাকতে। আমরা তার পাশের ঘরে গেলাম। এই ঘরটাই ডানদিকের প্রথম ঘর। পাশের ঘরটাও আকারে এক। যেহেতু খাওয়ার ঘরের সাথে রান্নাঘর ছিল তাই খাওয়ার ঘরটা অপেক্ষাকৃত কম জায়গা নিয়েছে। এখানে সবটুকু জায়গা নিয়েই একটা বড় ঘর। যার সামনে আছে একটি কাঁচের শোকেস। লাল মখমলের সোফা। যার সামনে রাখা আছে একটা টি- টেবিল। পেছনে রয়েছে একটা বেশ বড় আকারের সেগুন কাঠের খাট। আমি ইন্টেরিয়রের কাজ করি বলে সমস্ত আসবাবপত্র দেখেই তার আনুমানিক মূল্যায়ন করতে পারি। বুঝতে অসুবিধা হল না যে এই ব্যবসায়ী বাড়ির আর্থিক দিক যথেষ্ট বলীয়ান।
সমস্ত ঘরের সাথেই আছে বারান্দা লাগোয়া খরখরি দেওয়া জানলা। আর বাড়ির প্রধান দরজা ছাড়া প্রতিটি ঘরের দরজাই মজবুত কাঠের দু পাল্লার। প্রতিটা দরজার সামনে রয়েছে লোহার কড়া। আমরা ঘরে ঢুকতেই অনামিকা দেবী সোফার দিকে দেখিয়ে বললেন
- বাবাকে এখানে পাওয়া গেছিল। এটা বাবার ঘর।
আমি ডানদিকের দেওয়ালের দিকে তাকালাম। একখানা পুরনো বড় ফটোফ্রেমের পাশে একখানা অপেক্ষাকৃত ছোট ঝকঝকে নতুন ফটোফ্রেম রাখা হয়েছে। পুরনো ফটোতে একজন পঞ্চাশোর্ধ সধবা মহিলা। পরনে গাঢ় নীল জামদানি। গায়ে গয়না। নতুন ফটোফ্রেমে সত্তোরোর্ধ বয়স্ক একজন। পাট করা সাদা চুল। ধবধবে সাদা ফতুয়া। চোখে স্টিল ফ্রেমের সরু চশমা। হাসিমুখের গোলগাল চেহারা। আমি আর ঋজু ঘরের চারপাশে তাকাচ্ছিলাম। নীচ থেকে কল্পনা নামের পরিচারিকা এসে বললেন
- মেজ বৌদি বলল, যারা এসচে তাদেরকে নীচে নিয়ে যেতে। তাহলে চা টা কী করব? নীচে নিয়ে যাব?
একটু অপ্রস্তুত হয়ে অনামিকাদেবী বললেন
- তাই কর। আমি আর নামছি না। তুমি নিয়ে যেও।
পাশ থেকে পলাশবাবু বললেন
- তুমি সাথে যাও, নাহলে...
পলাশবাবু আর বললেন না। তবে, বুঝতে অসুবিধা হল না যে ওনারা আমাদের সম্মানের কথা চিন্তা করেই বলছেন। কারণ, মেজবৌদি নামক মহিলার চরিত্রগত পরিচয় আমরা আগেই ওনাদের থেকে পেয়েছি। আমরা দোতলায় নামলাম। পলাশবাবু ওপরেই থেকে গেলেন। অনামিকাদেবী সঙ্গ নিলেন।
দোতলায় নেমে ডানদিকের প্রথম ঘরে দেখলাম তালা দেওয়া। দ্বিতীয় ঘর থেকে টিভির আওয়াজ আসছে। কার্টুন চ্যানেল চলছে। আমরা ঢুকলাম সেই ঘরে। একই আকারের ঘর। বাঁ দিকের দেওয়াল বরাবর সামনে একখানা সিঙ্গেল কাঠের ডিভান রাখা। আর উল্টোদিকে একটা বেশ বড় আকারের সেন্টার টেবিল। যার পেছনে ডানদিকের দেওয়াল বরাবর রাখা আছে একটা কাঠের সোফা। ডিভানে বসে আছে তিনটে বাচ্চা। একটি ছেলের বয়স বছর দশ-এগারো হবে। একটি মেয়ে বছর দশের মধ্যে এবং আরেকটি বয়সে একটু ছোট একটি মেয়ে। তিনজনই আমরা আসাতে বিরক্ত। কারণ, তাদেরকে টিভির আওয়াজ কমানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশকারী মহিলা বসে আছেন কাঠের সোফায়। আমাদেরকে দেখে অভ্যর্থনা তেমন প্রানবন্ত দেখলাম না। আমাদেরকে বললেন
- আপনাদের কী ব্যাপার? মানে, সবই তো হল। পুলিশ তো আব্বুলিশ দিয়ে চলে গেছে। আবার অন্য অফিসারকে পাঠিয়েছে নাকি? আমি তো থানায় গিয়ে কথা বলে এলাম, যা করার আমি করব। এই মাইতি বাড়ির জীবিত মানুষ বলতে আমিই রয়ে গেছি। কেন যে বাইরের লোক এত মাথা ঘামাচ্ছে, কে জানে!!
বুঝতে অসুবিধা হল না যে কথাগুলো অনামিকা দেবীকে লক্ষ্য করে। ভাবলাম এই বুঝি শুরু হল ননদ- বৌদি সংঘাত। অনামিকা দেবী অপমানটা হজম করে নিয়ে নীচু স্বরে বললেন
- মেজবৌদি, তেমন কোনো জোরাজুরি নেই বুঝলে। আমি আজ বাইরের লোক, ঠিকই বলেছ। তবে, তারা তো আমারও বাবা- ভাই ছিল। তাই আমিও চেষ্টা চালাচ্ছি সত্যিটা জানার। ওনারা শুধু জানতে চেয়েছেন যে পায়েসের কাপের সেটে কটা কাপ ছিল।
মহিলা যেন মনে হল একটু ঠান্ডা হলেন
- ওটাতে আটটা কাপ থাকার কথা। সেদিন তো ছাই আমি ছিলাম না যে বলব! ওনারা কী থানা থেকে এসেছেন?
উত্তরটা আমরাই দুদিকে ঘাড় নেড়ে দিলাম। কল্পনা নামের মহিলা দেখলাম চা নিয়ে এসে আমাদের পেছনে দাঁড়ালেন।
অনামিকা দেবী বললেন
- ওনারা আমার কথাতেই এসেছেন বুঝলে। প্রাইভেটলি তদন্ত করিয়ে দেখতে চাইছি কী বেরোয়।
মেজবৌদির জিজ্ঞাসা এবার সরাসরি ননদকে
- ঠিক আছে। তা তালার কথাটা বলেছ? বনানীর সাথে কথা বলিয়েছ?
তুমিই একটু বলে দাও সুবিধা হয়।
মহিলা পানভরা গাল নিয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল
- এই তোমরা একটু বাইরে যাও তো। আর বন্ধ করো এই চ্যানেল! দেখে দেখে মাথার পোকা বেরিয়ে যাচ্ছে!! আর মলি, তোমাকে বলি, এভাবে তদন্ত হয় না। সবার সাথে বন্ধ ঘরে কথা বলাতে হয়। বনানীর সাথে তো অবশ্যই। আর আমিও এভাবে কথা বলব না। পারলে একা বলব, না হলে না।
অনামিকা দেবীর ডাক নাম মলি সেটা বোঝা গেল। আরো বোঝা গেল যে মেজবৌদি মহিলা আচার-ব্যবহারে সত্যিই উগ্র। অনামিকা দেবী আমাদের সেখানেই রেখে বেরিয়ে গেলেন। আমরা গিয়ে বসলাম ডিভানে। কল্পনা নামের মহিলা আমাদের চা দিয়ে গেল। মেজবৌদি মহিলার মুখে পান আছে বলে তিনি চা খেলেন না। যাওয়ার সময় মহিলা ইশারায় দরজাটা বন্ধ করে দিতে বললেন।
ঋজু বলল
- আপনিই বলুন।
মহিলা পাশে রাখা পানের বাক্সটা বন্ধ করে পাশে রেখে বললেন
- দেখ ভাই, অনেককেই বলেছি,আপনাদেরও বলছি, সমস্ত মানুষকেই মেরে ফেলা হয়েছে। আর এই ঘটনা অনেক আগেই হতে পারতো। সেসব জেনেই তো আমার সাথে শ্বশুরের ঝামেলা হয়। আমরা ভাই বাঙাল। যা বলি স্পষ্ট মুখের ওপর বলি। একটা বয়স্থা মেয়েকে বাড়ির নীচে কেউ রাখে? যেখানে তোমার বাড়িতে একটা অবিবাহিত পাগল ছেলে আছে!!
আমি একটু অবাক হয়েই বললাম
- ছোট দেওরের কথা বলছেন? ওনার মাথা ঠিক ছিল না?
- কোত্থেকে ঠিক থাকবে? কম বয়সে ব্যাঙ্গালোর পড়তে গিয়েছিল। পড়া তো মাথায় উঠেছে। বাবার পয়সার শ্রাদ্ধ করে এমন নেশাভাঙ করেছে যে লোক দিয়ে ধরেবেঁধে আনতে হয়েছে। তারপর তো কারখানায় গিয়ে বসিয়ে রেখেছে দাদারা। কাজে অষ্টরম্ভা। পাশে যে মেজদা, মেজবৌদি থাকে তার সেসব হুশ নেই। এমন সব ইংলিশ অ্যাডাল্ট সিনেমা রাতে দেখে যে রাতে বারান্দায় কান পাতা দায়। রাতের পর রাত জেগে থাকে। হয়ত কিছু নেশাও করে। আমি তো ওদিকটায় ভয়ে যাইনা। আমার বাথরুম ডানদিকে আলাদা। ঘরদোর কাউকে পরিস্কারও করতে দেয় না। আমি অনেক আগেই সবাইকে সাবধান করেছিলাম। মেয়েটাও তো নষ্ট চরিত্রের। ওকে দিয়েছিল বাবার ওষুধ আনার আর খাওয়ানোর দায়িত্ব। বুঝুন কারবার!! ওষুধ কিনতো, বিল দিতো না। প্রতি মাসে ওর আনা ওষুধের দাম দেখুন এখানে লিখে রেখেছি। কম করে প্রত্যেক মাসে পাঁচশো টাকা সরাতো। আর এই হচ্ছে প্রেসক্রিপশনের জেরক্স। এইসব চোর-চামারদের কেউ কখনো বাড়িতে রাখে?!! আমি তো জোর করে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলাম। তাতে যে যা ভাবে ভাবুক।
কথাটা বলতে বলতেই মহিলা একটা ছোট নোটবুক বার করে ঋজুকে দেখালো। ঋজু দু-তিনটে ফটো নিয়ে রাখলো মোবাইলে। তারপর বলল
- আপনার ননদ বললেন আপনি নাকি বলেছেন যে তালা পাল্টানো হয়েছে?
- এমনি বলেছি নাকি? চাবির নাম্বারেই তো গন্ডগোল ধরা পড়েছে। একই কোম্পানির কিন্তু অন্য তালা।
- আচ্ছা!! আপনার চোখে আর কোনো এমন জিনিস যা থাকার কথা নয়? বা কোনো অসঙ্গতি?
- আপনাদের যে চা দিলো,তার নাম কল্পনা। ও একটা জিনিস দেখে আমাকে বলেছে। যদিও আমি সে কটা দিন ছিলাম না। আমি বাপের বাড়িতে গেছিলাম। বাচ্চারাও গেছিল। এখন ভাবছি, না গেলে বাচ্চাগুলোর যে কী হত!! আবার ভাবছি যদি থেকে যেতাম তাহলে হয়তো এত কিছু হতই না। আমার স্বামীকেও এভাবে হারাতে হত না। আমার স্বামীর সাথে ভিডিও কল করে কথা বলে আমার মেয়ে। বড়বৌদিও ছিল। আমার স্বামীর মৃত্যুর সময় তো তার কিছু পরেই।
ঋজু বলল
- ভিডিও কল কটা নাগাদ করেছিল?
- দশটা বারো। আমার মোবাইলে টাইম এখনো দেখাতে পারব।
আমি মহিলাকে মনে করালাম
- কী একটা বলছিলেন, কল্পনা কী দেখেছে?
- ও হ্যাঁ, কল্পনা আমাকে বলল যে ছাদ থেকে তিনতলায় নামার সিঁড়ি আগের দিনই ও ভালো করে মুছেছে। কোনো রঙ ছিল না। কিন্তু ঘটনার দিন সকালে নাকি ছাদ থেকে তিনতলায় নামার সিঁড়িতে রঙ ছিল।
আমি আর ঋজু কথাটা শুনে চোখাচোখি করলাম।
ঋজু প্রশ্ন করল
- কিন্তু, ছাদের দরজা তো বন্ধ ছিল?
- যদি বন্ধও হয়, বন্ধ দরজা খুলতেই বা কতক্ষণ? আর খোলা দরজা বন্ধ করতেই বা কতক্ষণ? কেউ যদি ভেতর থেকে ছাদের দরজা খুলে দেয় তাহলে ছাদ থেকে নীচে নামতেই পারে।
- কেউ বলতে, আপনি কাকে সন্দেহ করেন?
- বললাম তো, একতলার মেয়েটার খুব লোভ। আকাশে আর কত থুতু ছেটাবো!! ঝি-চাকরের মেয়ে দুটো পড়াশোনা করলেই কী আর জাতে ওঠে?!! দরজা খুলে ঢুকিয়ে দিয়েছে লোক।
- মেইন দরজার চাবি কোথায় থাকে?
- সমস্ত চাবির একটাই গোছা। বড়দির ঘরেই থাকতো। আমি যেহেতু নীচের বনানীর ঘরে তালা দিয়েছিলাম তাই সেই তালাটার আরো দুটো চাবি আমার কাছে ছিল। আর মেইন দরজার চাবি রাখতাম। নাহলে প্রতিবার দরজা খোলার সময় তিনতলায় উঠতে হত। এসে দেখছি আমার চাবির রিংটাও কেউ সরিয়ে দিয়েছে।
- আপনার কাছে বনানীর ঘরের চাবি ছিল না?
- হ্যাঁ, আলাদা দুটো রাখা ছিল। আমার কাছে একটা আছে, যেটা মেইন দরজার চাবির রিং-এর সাথে থাকত না, আলাদা রিং-এ রাখা ছিল, এটা চুরি হয়নি। আরেকটা বড়দির কাছে একটা ছিল। এখন দেখছি নাম্বারে মিলছে না। এখন যদি বড়দি নিজে থেকে না চেঞ্জ করে তাহলে কে করল? ভূতে?!!
- আপনার চাবিগুলো দেখাতে পারবেন?
- হ্যাঁ, একদমই পারব।
মহিলা উঠে গিয়ে একটা ব্যাগের ভেতরের পকেট থেকে একটা চাবির রিং বার করে বললো
- এই যে দেখুন। নাম্বার লিখে নিন। চাবির গোছার সাথে দেখবেন মিলছে না। চালাকি করে একই কোম্পানির একই তালা কেউ লাগিয়েছে।
- আর মেইন দরজার চাবি?
- মেইন দরজার তো অন্যরকম চাবি। পেতলের রঙের। সেটার চাবিও তো আমার গোছার সাথে উধাও।
ঋজু বনানীর ঘরের চাবিদুটোর নাম্বার দেখতে দেখতে বলল
- আর বাড়ির সমস্ত চাবির গোছাটা কোথায়?
- আগে তো বড়দির ঘরেই থাকতো। এখন ওপরে খাওয়ার ঘরেই রাখছি আমি যতদিন আছি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম
- যতদিন আছি মানে? কোথাও যাচ্ছেন নাকি?
- না মানে, বাড়িটাই রাখব না। এতবড় তিনতলা বাড়িতে একজন মহিলা আর দুজন বাচ্চা থাকতে পারে? বাড়িতে অমঙ্গলের ছায়া পড়েছে। এবাড়ি বেচে দেওয়াই মঙ্গল। একটা ফ্ল্যাট কিনে নিয়ে থাকব।
ঋজু চাবি দুটো ফিরিয়ে দিয়ে বলল
- কোথায় যাবেন? ডানকুনিতে?
- ওমা! ডানকুনিতে থাকতে যাব কেন? কারখানা দেখতে হবে যে। এসব আবার কে বলল আপনাকে? মলি?
- নাহ্, এমনিতেই বললাম। আপনার নামটা জানা হল না।
- শর্বরী মাইতি।
- আচ্ছা শর্বরীদি বাড়ির মেইন গেটের চাবি তাহলে কেবলমাত্র আপনার কাছেই ছিল?
- তার মানে?!! কী বলতে চাইছেন বলেন তো? বললাম যে চাবিটা উধাও, পাওয়া যাচ্ছে না।
- কিছুই না। মানে যদি কেউ গেট বন্ধ অবস্থায় রাতে বাড়িতে ঢুকতে চাইতো তাহলে একমাত্র উপায় ছিল আপনার মেইন গেটের চাবি। সেটা বলছেন আপনার কাছে ছিল না?
মহিলা হঠাৎ কেমন যেন মেজাজ হারিয়ে ফেলে বললেন
- আপনার হয়ে গেছে? আসতে পারেন তাহলে। আমার প্রচুর কাজ পড়ে আছে।
আমরা উঠে গেলাম। দরজা খুলে বেরোতেই মহিলা আরো মেজাজ হারালেন। আমাদের কানে আসতে লাগল সমস্তটাই
- গোয়েন্দা লাগিয়েছে!! গোয়েন্দা না দালাল!! নিজে এতবড় কান্ড ঘটিয়ে এখন গোয়েন্দা দিয়ে কেস সাজাচ্ছে। আমাকে চেনো না তো! আমি কেস - টেস বুঝি না। বেগতিক দেখবো কি আঁশবটি নিয়ে তেড়ে যাব। এই বাড়িতে পা রাখাই বন্ধ করে দেব। সম্পত্তির লোভ ঢুকিয়ে দেব একেবারে। নিজের স্বামীকে সামলাতে পারিস না!! তোরাই মেরেছিস সবাইকে! নিজেরা পায়েসে বিষ মিশিয়ে সেই পায়েসে আর মুখ দিলি না!! ভেবেছিস বুঝতে পারি না!!
মেজাজ ক্রমশ উর্ধ্বমুখী। এগিয়ে যেতেই দেখলাম সিঁড়ির মুখে পলাশবাবু। হাত জোড় করে বললেন
- আমি ক্ষমা চাইছি ওনার হয়ে। আপনাদের কি আর কিছু দেখার আছে?
ঋজু বলল
- বাড়ির ছোটছেলে, মানে অজয় মাইতির ঘরটা কোনদিকে?
- আসুন। এদিকে সোজা।
দোতলায় উঠে বাঁদিকের ঘরটাই ছোটছেলের। ঘরটা বাইরে থেকে তালাবন্ধ। এবং তালার ওপরে পুলিশের সিল মারা আছে। ঋজু আর আমি জানলার খড়খড়ি দিয়ে ভেতরটা দেখলাম। একটা বড় ঘরের পেছনদিকে একটা সিঙ্গেল খাট। ঘরে আসবাবপত্র তেমন নেই। একপাশের দেওয়ালে লাগানো আছে একটা টিভি ইউনিট। যার ওপরদিকে রাখা আছে দুটো সাউন্ডবক্স। আরো কিছুটা ওপরে লাগানো আছে একটা বড় এল ই ডি টিভি। বাঁদিকে একটা ছোট টেবিল। তাতে রাখা আছে কয়েকটা জলের বোতল। শেষ বিকেলের আলোয় ঘরের ভেতরটা আরো অন্ধকার। এর বেশি কিছু দেখা গেল না। আমরা পলাশবাবুকে বললাম একবার ছাদটা দেখার জন্য। এবং সেটাও খুব তাড়াতাড়ি। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে পাঁচটা। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে গা এলিয়ে দিয়েছে। তিনতলায় উঠে সামনে পেলাম অনামিকাদেবীকে। এগিয়ে এসে বললেন
- আপনাদের হেনস্থার জন্য আমি দুঃখিত। বলেছিলাম না, মহিলা ভীষণই বেগতিক বুঝলেন।
ঋজু সেসব কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে বলল
- ও কিছু না, ছেড়ে দিন। একবার ছাদে যেতে হবে। আলো পড়ে যাচ্ছে। আপনাদের কাজের মেয়েটিকেও ডাক দেবেন।
অনামিকাদেবী ডাক দিলেন কল্পনাকে। কল্পনা আসার আগেই আমরা ছাদের দিকে উঠতে শুরু করলাম। তিনতলায় উঠে অল্প একফালি জায়গা যেটা পেরোলেই ছাদের দরজা। এই দরজাটা একমাত্র বাড়ির অন্যান্য দরজার থেকে দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ছোট। অনামিকাদেবী তালা খুললেন। আমরা সবাই ঢুকলাম ছাদে। আমাদের পেছনে কল্পনাও এসে দাঁড়ালো। লম্বা বিস্তৃত ছাদ। দরজার সোজাসুজি মিটার সাতেক পরে তৈরী করা আছে একটা সিমেন্টের পাঁচফুট উঁচু ধাপি। যার ওপরে আছে দুটো সুবিশাল কালো জলের ট্যাঙ্ক। আর ধাপির নীচের দিকে রাখা আছে একটা কল। ধাপির দুপাশে দুদিকে লম্বাটে চওড়া জায়গা। পাঁচিলও বেশ উঁচু এবং পাকাপোক্ত।
ঋজু আর আমি চারপাশে পাক খেলাম। ছাদের জায়গায় জায়গায় দোল খেলার চিহ্ন হিসেবে এখনো রঙ লেগে আছে। ঋজু কল্পনার থেকে জানতে চাইল
- ছাদের থেকে কোন সিঁড়ি অবধি রঙ লেগে ছিল?
কল্পনা ভেবে নিয়ে বলল
- এই তো,দরজার পর থেকেই প্রায় চার পাঁচটা সিঁড়ি অবধি।
- কী রঙ ছিল?
- গোলাপি। আবির ছিল। এখন তো আবিরেও রঙ থাকে তাই চট করে যায়নি।
- যত তলার দিকে নেমেছে তত কমেছে?
- হ্যাঁ, চার-পাঁচ সিড়ি অবধি কমে কমে শেষে আর ছিল না।
- আর সেই গোলাপি আবির ছাদের কোথায় ছিল মনে আছে?
- না দাদা, অতো মনে নেই। তবে কলের দিকেই বেশিরভাগ রঙ খেলা হয়েচে।
এসব কথা হল ছাদের আর তিনতলার মাঝের ল্যান্ডিং এ। ঋজু আরো একবার ছাদে গেল দুমিনিটের জন্য। এরপর আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। দোতলায় বাড়ির মেজবৌয়ের চিৎকার তখনো তুঙ্গে। আমরা একেবারে নীচে এসে দাঁড়ালাম সেই বিতর্কিত দরজার সামনে। তারপর ঋজু ঝুঁকে পড়ে তালাটা দেখলো। আমিও দেখলাম। স্টিলের মাঝারি থেকে একটু বড় সাইজের তালা। এরপর মেইন গেটের দিকে দেখলাম। একপাল্লা দরজার বাঁদিকে মাঝামাঝি বসানো ছিল এক নামি কোম্পানির বেশ দামি ট্রাইবোল্ট লক। বহু সাধ্যসাধনার পরে যার বাঁদিকে লক করার জায়গা ভেঙে ফেলা হয়েছে। দরজার ওপরের দিকে রয়েছে একটা বড় ছিটকিনি। সেটাকেই মনেহয় ভাঙার পরে মেরামত করে কাজ চলছে।
ঋজু জিজ্ঞেস করলো
- এখন তাহলে এই ছিটকিনি দিয়েই কাজ চলছে?
অনামিকাদেবী বললেন
- আপাতত তাই চলছে। মেজবৌদি দোতলার গ্রীলে তালা দিয়ে রাখে সবসময়। চলুক। মেজবৌদির যা মতিগতি তাতে বাড়িঘর কিছুই রাখবে না মনেহয় বুঝলেন। এত বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও যে মহিলার লোভ না কমে বেড়ে যায় তাকে আর কী ভরসা!!
ঋজু জিজ্ঞেস করল
- আপনার বাবা কিছু উইল করে গেছেন?
- না, উইল কিছু করেনি। মুখে মুখেই বলে গেছিল যে যা আছে সবই চার ছেলে-মেয়ের। এখন দেখছি আমাকে বাদ দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে বুঝলেন। এমনকি আমার বড়দার ছেলেকেও আমাকে দেবে না বলছে। মেজবৌদি এখন বোবোর কাস্টডি চাইছে যাতে বড়দার ভাগটাও সে পায়। মেজবৌদির এই কদিনে এত পরিবর্তন সত্যিই ভাবাচ্ছে! সত্যিই যে তার হাত নেই সে কথা হলফ করে বলা যাচ্ছে না বুঝলেন। আর বোবোকেও এই কদিনে হাত করে ফেলেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম
- বোবো কি আপনার বড়দার ছেলে?
- হ্যাঁ।
ঋজু জিজ্ঞেস করল
- আর আপনি? আপনিও কি তাই চাইছেন? বড়দার ভাগ?
- একটা বাচ্চাকে মানুষ করতে গেলে কী এখন কম খরচ? যদি চাই অন্যায় কি?
ঋজু প্রত্যুত্তরে বলল
- সে যাই হোক। আপনাদের পারিবারিক ব্যাপার। আমি এব্যাপারে নাক গলাব না। আমার আর একজনের সাথেই কথা বলার বাকি আছে। বনানী পাল, যাকে নিয়ে এত জল্পনা!
আপনি একটা কাজ করুন আপনি এই তালাটাই খুলে ঢুকুন। ওনার ঘরে গিয়েই কথা বলি।
অনামিকাদেবী আমাদের সামনেই ফোন করলেন
- বনানী, আমি এপাশের তালাটা খুলছি। তুমি একটু দরজাটা খুলে দাও ভেতর থেকে। একজন এসেছেন,কয়েকটা কথা বলেই চলে যাবে।
ফোনের ওপাশ থেকে বোধকরি সম্মতি জানালো। এদিক থেকে তালা খোলা হল। দরজার ওপাশ থেকেও খোলা হল ছিটকিনি আর খিল। আমরা ঘরটায় ঢুকলাম। একটা মাঝারি আকারের ঘর। একদম শেষ প্রান্তের ডানদিকের কোনায় লম্বাটে বাথরুম।বাঁয়ে রাস্তার দিকে একটা খড়খড়ি দেওয়া জানলা। যাকে পেছনে রাখলে একটা ছোট ডবল খাট রাখা ডানদিক ঘেঁষে। বাঁদিকে বাথরুমের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা আছে একখানা টেবিল। যাতে আছে যাবতীয় রান্নার সরঞ্জাম। একটা ছোট সিলিন্ডার সমেত ওভেন। টেবিলের পাশেই আছে একটা পুরনো কাঠের টিভি স্ট্যান্ড যার একটা পায়া খারাপ হওয়ায় ইঁট দেওয়া আছে।একটা পুরনো চোদ্দ ইঞ্চির টিভি রাখা আছে তাতে। বনানী পাল আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। উচ্চতা পাঁচফুটও হবে না। রোগাটে গড়ন। মাজা রঙ। চেহারা সুন্দর। বেশভূষা বেশ আধুনিক। ওপরে একটা ঘিয়ে রঙের টপের নীচে পরা আছে একটা কালো জংলী ছাপের পালাজো। আমাদের হাত জোড়া করে নমস্কার করে বললেন
- বলুন, কী জানতে চান?
ঋজু ঘরে ঢুকে কেমন একটা থম মেরে গেল। ঋজুর হুশ ফেরানোর জন্য বললাম
- কি রে!! বল যা বলবি।
ঋজু চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল
- আপনি এখানে আছেন তো একবছর হল?
- একবছরের বেশি। প্রায় দেড়বছর হতে চলল।
- সেদিনের ঘটনা জানি অনেককেই বলে বলে মুখ ব্যাথা হয়ে গেছে। তবু যদি কষ্ট করেন।
বনানীর চেহারাই তার মানসিক অবস্থার দুর্দশা বুঝিয়ে দিচ্ছে। চোখ দুটো চিন্তায় প্রায় কোটরে ঢুকে গেছে। মুখটা ঈষৎ বেঁকিয়ে একটু হেসে বলল
- না না, কাজের লোকের আবার কষ্ট কী! যতবার যতজন জিজ্ঞেস করবে, ততবারই আমাকে বলতে হবে।
ঋজু কথাটা শুনে একটু বিরতি নিয়ে বলল
- সেদিনের কথা যতটা মনে আছে বলুন।
- সেদিন মলি দিদি আর জামাইবাবু এসেছিলেন। বড়বাবুর জন্মদিন ছিল। বড়দা আর আমি মিলে বাজার করি। সমস্ত জোগাড়ের কাজ করেছিল কল্পনা। বড়বৌদি রান্না করেছিল।
- আপনি রান্না করার সময় ছিলেন না?
- না, আমি বাড়ির ভেতরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি মাস তিনেক আগেই। আগে বড়বৌদির কাছে যেতাম বলে বড়বৌদিকে বিভিন্ন কথা শুনতে হত। এখন আর যাই না। দুমাস আগে গেছিলাম। বড়বাবুকে একটা ওষুধের চার্ট করে দিয়ে এসেছি যাতে সময়মত ওষুধটা খেয়ে নিতে পারে। তাও ফোন করে মনে করাতাম। বড়বাবু হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তাই তিনিও আর ডাকেননি।
- কার কার আপত্তি ছিল বলা যায়?
বনানী একবার আড়চোখে অনামিকাদেবী আর পলাশবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল
- শেষের দিকে প্রায় সবারই আপত্তি ছিল, ছোড়দা ছাড়া।
-কেন?
- জানা নেই। কেউ বলেছে,গরীব হাভাতে ঘরের মেয়ে বড়বাবুকে ফুঁসলিয়ে কিছু লিখিয়ে নেবে। কেউ বলেছে, নষ্ট চরিত্রের। কেউ বলেছে,ওষুধের মধ্যে অন্য কিছু খাইয়ে দেবে।
- বড়বাবুর ওষুধ কি আপনিই আনতেন?
- হ্যাঁ গত পাঁচবছর ধরে আমি এনে দিই। কিন্তু, দুমাস হল আমাকে আর আনতে দেওয়া হয়নি।
পলাশবাবু বললেন
- গতমাসে আমি দোলের দিনই ওষুধ এনে দিয়েছি। তার আগের মাসে মনেহয় বড়দা এনেছিল। কারণ, বড়দাই আমাকে বলল দোলের দিন উনি বেরোবেন না,আমাকে নিয়ে আসতে।
- কোন দোকান?
- মেট্রো স্টেশনের পাশে। পাশেই তো কেকের দোকান। সেজন্যই তো সেদিন কেক অর্ডার করে এলাম।
ঋজু এরপর বনানীর দিকে ফিরে বলে
- হ্যাঁ বলুন, তারপর?
- তারপর মলিদিদি এসে আমাকে নক করেন। বলেন দরজা খুলে ওপরে গিয়ে খাবার নিয়ে আসতে। বড়বৌদি ডাকছে। ইচ্ছে ছিল না যাওয়ার। শুধু বড়বৌদির মুখ চেয়ে যেতে হয়েছিল।
- আপনার জন্যেও ছিল পায়েস?
- হ্যাঁ, বড়বৌদি আমার জন্যে সব রান্নাই বেড়ে রেখেছিল। তাতে পায়েসও ছিল। বলল, কেকটা এখনো আনা হয়নি। পরে কেকটাও দিয়ে যাচ্ছে।
- আপনি কী বললেন?
- আমি কিছু বলিনি। বড়বৌদি আমাকে মায়ের মত স্নেহ করতেন বলে মুখের ওপর আমি কিছু বলিনি কোনদিন।
- এরপর?
- এরপর বড়বৌদি আমার হাতে আমার খাবার আর নিজে পায়েসের ট্রে নিয়ে নীচে নামেন।
- দোতলায়?
- হ্যাঁ দোতলায়। মেজদার ফ্রিজে রাখার জন্য।
- আর আপনার পায়েসটা?
- আমারটা আমি তখনই নিয়ে চলে এসে খেয়ে নিই।
- কী কী ছিল পায়েসে?
- বড়বৌদি তো অনেক কিছু দিয়েই ঘন দুধের পায়েস বানায়। কাজু,কিসমিস,পেস্তা আরো অনেক কিছু। এখন তো তেমন মনে নেই।
- মিষ্টির পরিমাণ?
- হুম, আমার তো ঠিকই লেগেছে।
- বেশ তারপর?
- তারপর আমার দরজা আমি বন্ধ করে দিই।
- আর খোলেননি?
- হ্যাঁ খুলেছিলাম। জামাইবাবু যখন বেল বাজালেন তখন আমি খুলে দিই। বড়বৌদিকে ফোন করে বলেওছিলাম যে নামতে হবে না।
পাশ থেকে পলাশবাবু বললেন
- ওই যে বললাম না, কেক আনতে গেছিলাম। যখন ফিরলাম তখন ও খুলে দেয়।
- আর নামার সময়?
- বেরোনোর সময় তো লাগে না। অটোমেটিক লক আছে। বাইরে থেকে টানলেই লক হয়ে যায়।
- আচ্ছা বেশ। আচ্ছা বনানী, আপনার পায়েসের কাপটা কী পুলিশ নিয়েছিল?
- না। আমার পায়েস কাপে ছিল না। আমার পায়েস বাটিতে ছিল। এই বাড়িতে সমস্ত কাজের লোকের বাসন আলাদা থাকে। আমার মা এই বাড়িতে কাজ করতো বলে আমিও সেই গোত্রে পড়তাম।
- ওহ্ আচ্ছা। তারপর?
- তারপর আর আমি কিছু জানি না। রাত দশটার পরে বড়বৌদি, মলিদিদি আর জামাইবাবুর গলার আওয়াজ পাই। বড়বৌদি নীচে নেমে আমায় ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, খাবার কেমন হয়েছে?
- কী বললেন?
- বললাম, এখনো খাইনি। খেয়ে বলে দেব। মলিদিদি আর জামাইবাবুও সাথে ছিল। তারপর আমিই দরজা তালা লাগিয়ে দিতে বললাম বড়বৌদিকে।
- বড়বৌদিই তালা লাগিয়েছিল?
- তা তো আমি জানি না। আমি তো দরজার এপারে ছিলাম।
ঋজু এবার অনামিকা আর পলাশ পালুইকে উদ্দেশ্য করে বলে
- আপনারা লাগিয়েছিলেন?
অনামিকাদেবী বললেন
- আমি একটা কড়ায় তালাটা আগে থেকেই লাগানো ছিল দেখেছি। কিন্তু,দুটো কড়ায় তালা বড়বৌদি আমাদের সামনেই লাগিয়ে দেয়। তারপর, আমরা বেরিয়ে যাই।
ঋজু অবাক হয়ে বলল
- আশ্চর্য!!
অনামিকাদেবী বললেন
- হ্যাঁ সকালে তো আমিও দেখেছি তালা লাগানো। এমনকি প্রথমে যে ইন্সপেক্টর দরজার লক ভেঙে ঢোকে সেও তালা লাগানোই দেখেছে বুঝলেন।
ঋজু কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে বলে
- আচ্ছা ঠিক আছে, বনানী আপনাকে আমার আবার প্রয়োজন হতে পারে। আপনি তো আপাতত এখানেই থাকছেন?
একটা শুকনো হাসি হেসে বনানী বলে
- থাকছি মানে! থাকতে বাধ্য। আমাকে বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে মানা করেছে। যবে থেকে ঘটনা ঘটেছে তখন থেকেই ঘরবন্দি। পুলিশ এসে না দেখলেই অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বেরিয়ে যাবে।
আমি সহানুভুতির সুরে জিজ্ঞেস করলাম
- সেকী!! আর আপনার দোকান-বাজার? খাওয়াদাওয়ার তো ভীষণই অসুবিধা হচ্ছে।
- হচ্ছে। কী আর করা যাবে। কাল অফিসার এসেছিল। বলল কেস ক্লোজ হয়ে যাবে। আর কটা দিন ধৈর্য ধরতে।
- কোন অফিসার?
পাশ থেকে পলাশবাবু বললেন
- অফিসার বৈদ্য দেখছেন আমাদের কেসটা। ওরই নির্দেশে সব হচ্ছে।
আমরা আমাদের যা দেখা বা জানার তার সবটাই সেরে ফেলেছিলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়েই ঋজু একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিলো। আমিও একটা সিগারেট ধরালাম। কেসটা একসময় মনে হচ্ছে জলবৎ তরলং। পরের মুহূর্তেই যখন গভীরে যাচ্ছি তখন তল পাচ্ছি না। হাঁটতে হাঁটতে ঋজুকে বাজানোর জন্য বললাম
- পুলিশের অনুমানটাই ঠিক মনে হচ্ছে জানিস। ছোটছেলেটার তো এমনিতেই মাথার কিঞ্চিত গোলমাল ছিল। সে পায়েসে বিষ মিশিয়ে নীচে চলে গিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সেই বিষ মেশানো পায়েস যে যখন খেয়েছে সে তখনই মারা গেছে।
ঋজু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল
- আর বনানী সেই বিষ হজম করে নিয়েছে?
- না ঠিক তা নয়। বনানীর পায়েসটা হয়তো আগেই বাড়া হয়ে গেছিল।আর ছোটছেলেটা তো বনানীকে ভালোইবাসতো। সেজন্য বনানীরটাতে মেশায়নি।
- তো ও নিজেকে মারলো কেন? সবাই যখন মরেই যাচ্ছে তখন তো আর বিয়ের বাঁধা রইলো না।
- হতে পারে পরে অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করেছে।
- জানি না রে। সবই সময়ের খেলা। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভেঙে মোর ঘরের চাবি গানটার অর্থ কেমন কুয়াশাচ্ছন্ন না? বুঝতে পারিস?
আমি দুদিকে মাথা নাড়লাম। এই একটা গান আমাকে ছোটবেলা থেকেই ভাবিয়েছে। সত্যিই বুঝতে পারি না তালার বদলে চাবি ভাঙার কথা কেন বলা হয়েছে।
ঋজু সিগারেটের শেষ অংশটা পায়ের নীচে ফেলে জুতো দিয়ে চেপে বলল
- ভেবে বল কালকে। এটাই তোর হোম-ওয়ার্ক।
আমি নিরাশ হয়ে বললাম
- অনেক ভেবেছি ভাই,পাইনি।
- পাবে পাবে। ঘটক বাবুর কথা ভুলে যেও না। এই ভবানীপুরের অলিগলিতে তিনিও ঘুরতেন। ভাবো, ভাবো,ভাবা প্র্যাকটিস করো। কাল বিকেলে দেখা হচ্ছে।
আমরা ঋজুর বাড়ির কাছে চলে এসেছি। আমার গাড়িটা ঋজুর বাড়ির কাছেই পার্ক করেছিলাম। ঋজু বাড়িতে ঢুকে গেল। আমিও গাড়িতে ঢুকে স্টার্ট দিলাম। মাথায় তুলে রাখলাম ভাবনা। সময় নিয়ে বাড়িতে ঢুকে ভাববো।
ক্রমশ...
পরবর্তী পর্বটি পড়ুন এই লিঙ্কে ক্লিক করে
পূর্ববর্তী পর্বটি পড়ুন এই লিঙ্কে ক্লিক করে
(বুকমেকার্স ও বন্ধুরা - শারদীয়া ১৪২৭ -এ প্রথম প্রকাশিত। অলঙ্করণঃ আশিস ভট্টাচার্য)
Comments